=এ কে কামাল, খাগড়াছড়ি=
সত্যিই বিচিত্র এক সংস্কৃতির আনন্দোৎসব যা এর আগে কখনও এত আনন্দ-উদ্দীপনা আর প্রশান্তির আমেজ মাখেনি। চলছে আজ কদিন ধরে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। দীর্ঘদিন পর মনে হচ্ছে পাহাড়িদের শতস্ফুর্ত আনন্দ।
অতীতে এতো জোরালো উৎসব তার করতে পারেনি বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে। সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আর্থসামাজিক দৈন্যতা, বেকারত্ব, আধুনিক শিক্ষার অভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতির অভাব সবকিছু মিলেয়ে এবারের নববর্ষ উৎসব আসলে ব্যতিক্রম।
অতীতে এতো জোরালো উৎসব তার করতে পারেনি বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে। সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আর্থসামাজিক দৈন্যতা, বেকারত্ব, আধুনিক শিক্ষার অভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতির অভাব সবকিছু মিলেয়ে এবারের নববর্ষ উৎসব আসলে ব্যতিক্রম।
ঐতিহ্যকে তারা এগিয়ে নিয়েছে অনেক আধুনিকে।
এবারের উৎসবে যেটা লক্ষ্যণীয় সেটা হলো- মারমাদের চতুরতা। তারা দেখলো চাকমারা কয়েক বছর আগে থেকে অনেক এগিয়েছে। বিগত সরকার পিরিয়ড়ে এগিয়েছে ত্রিপুরারা। তাই এবার মারমাদের পালা বা পরিকল্পনা যা তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচায়ক। তাদের আয়োজন যেন আগের তুলনায় অনেক উৎসবমূখর। দেখাতে চাচ্ছে আমরাও পারবো নেতৃত্ব চালাতে। চাকমা-ত্রিপুরাই শুধু নেতৃত্ব জানে তা নয়। আমাদেরকে এগিয়ে নিন।
তাদের সাংগ্রাই উৎসবব্যালী চোখে পড়ার মতো। মাদকদল, ভ্যানগাড়ীতে জেনারেটরসহ বিশাল সাইন্ডবক্স দিয়ে গান, সাংস্কৃতিক পোষাক, মুখে চন্দন আল্পনা, মাথায় ক্যাপ, পায়ে ঝুমকা, হাতে পেস্টুন, কোমরে নাচের তাল, লাইনের চন্দ, মাঝে মাঝে তরুণ-তরুণীদের হেলেধুলে নাচদল, সবার প্রতি নিমন্ত্রণ, অভিনন্দন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনা সবমিলিয়ে আনন্দবঞ্চিত সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মন কেড়েছে।
তাছাড়াও খাগড়াছড়ির সরকারি-বেসরকারি অনেক সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ তাদের সাথে উৎসবে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন অফিস, সংস্থা, সংগঠন, সমিতি, ক্লাব, পাড়া অনেক ধরনের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। চলছে ফলফ্রুটসহ রকমারি খাবারের ধুমধাম।
কোত্থাও কোনো ধরনের বিন্দুমাত্র বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি।
ঐতিহ্যের আলো মেখে উৎসবমুখর পরিবেশে চাকমাদের ফুল বিজু, ত্রিপুরাদের বৈসুমা ও মারমাদের আল্লেনিহয়ের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অন্যতম সামাজিক উৎসব বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু (বৈশাবি) উৎসব শুরু হয়েছে। উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের শহর গ্রামের নানা প্রান্তে চলছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে নানা খাবারের রকমারি আয়োজন। তিন দিন ধরে চলবে পাহাড়ে নানা আয়োজন। বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্য ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তা ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু তিন দিনের প্রথাগত সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যিক আচার অনুষ্ঠান হলেও চলে সপ্তাহ ধরে। পাহাড়ে মানুষ মানুষে সম্প্রতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পুরনো বছরের কালিমা এবং নতুন বছরের শুভ কামনায় নতুন বারতা নিয়ে পাহাড়ি প্ল্লী মেতে উঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসে। পাহাড়ের প্রতিটি ঘরের আঙিনায় উৎসব আর উচ্ছ্বাসের জোয়ার আসছে। মঙ্গলবার ছিল চাকমাদের ফুল বিজু,ত্রিপুরাদের বৈসুমা বৈসুক, মারমাদের আল্লেনিহ। নানা জাতের পিঠা-পুলি ঘরে ঘরে দিয়েছে উৎসবের নতুন মাত্রা। ভোরে ফুল তুলে তরুণ তরুনীরা দেবতার আশীর্বাদ পাওয়ার লক্ষ্যে নদী ও ছড়ায় ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে চাকমাদের ফুল বিজু শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় গৈড়িয়া নৃত্য, বোতল নুত্য পারিবেশন করছে নানা বয়সের শিল্পীরা। অন্যদিকে বাড়ির বয়স্ক গৃহবধুরা গৈড়িয়া দেবতার উদ্দেশ্যে চাল, ধান, টাকা উৎসর্গ করে নতুন বছরকে কল্যাণের দিকে আনতে মাঙ্গলিক পূজা করছে। চাকমাদের ‘গর্যাপার্যা’, ত্রিপুরাদের বিছিকাতাল বা আট্টদাং বৈষুক মারমাদের আছংনিহ সাংগ্রাই উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে মেতে উঠেছে কিশোর কিশোরি, যুবা, বৃদ্ধ সবাই। বৈসাবি উপলক্ষে বৈসু সাংগ্রাই উদযাপন কমিটি নাটক রং ‘পাহাড়ের পালা’, সাঁওতাল লিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এ উপলক্ষ খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সংগঠন যৌথভাবে আয়োজন করছে ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী ঘিলা খেলা, সুকুই খেলা, পাত্তি খেলা, গদু খেলা, ধ খেলা, ফোর খেলা, বেত দিয়ে কালোং তৈরি প্রতিযোগিতার। এছাড়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বদি খেলা, মাতৃভাষায় অনুবাদ প্রতিযোগিতা, বাঁশ ও পাতায় রান্নার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। চাকমাদের গেংখুলী, ত্রিপুরাদের গৈড়িয়া নৃত্য, বোতল নৃত্য, মারমাদের পানি খেলা উৎসবের আয়োজন চলছে। এদিকে রাঙ্গামাটিতে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশবাসীর প্রতি বিজু ও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাই। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিজু সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু উৎসব প্রাক্কালে সংবিধানে সরকারের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রয়াস এবারের উৎসবকেই ম্লান করে দিয়েছে। চাকমা রীতি অনুযায়ী মঙ্গলবার ভোরে পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুলবিজুর উৎসব শুরু হয়। এতে করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে মোছন করা হয়েছে অতীতের সব দু:খ কষ্ট, ব্যর্থতা পাপ আর গ্লানি। ফুল ভাসানোর উৎসবে অংশ নিয়েছেন আদিবাসীদের সব বয়সের নারী পুরুষ বিশেষ করে কিশোর কিশোরী এবং তরুণ তরুনীরা। রাংগামাটি শহরে ভোর সাড়ে ছয়টায় ফিশারি বাঁধ, রাজবাড়ী ঘাট, তবলছড়ি, রাঙ্গাপানি, আসামবস্তিসহ বিভিন্ন স্থানে পৃথকভাবে ফুল ভাসানো হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা পারিষদের চেয়াম্যান নিখিল কুমার চাকমার নেতৃত্বে শহরের রাজবাড়ী ঘাটে ফুল ভাসানো হয়। বিজু, সাংগ্রাই বৈসুক, বিষু, বিহু উদযাপন কমিটি ২০১১ উদ্যোগে ফিশারি বাঁধ এলাকায় আনুষ্ঠানিক ফুল ভাসানো উৎসব পালন করে। এ সময় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পারিষদ চেয়াম্যান নিখিল কুমার চাকমা সবার প্রতি বিজু ও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সরকারের প্রতি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান। সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. মানিক লাল দেওয়ান বলেন, সংবিধানে আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অভিহিত করার প্রাস্তাবে এবারের উৎসব পালন করতে হচ্ছে ভারাক্রান্ত মনে। তিনি বলেন, যারা আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অভিহিত করার কথা বলছে তাদের মনমানসিকা অত্যন্ত ক্ষুদ্র । ভোরে ফিশারি বাঁধ এলাকায় ফুল ভাসানের্ সময় সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. মানিকলাল দেওয়ান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব বোধিসত্ত চাকমাসহ অন্য নেতারা, এমএন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক বিয় বেতন চাকমা, গুর্খা নেতা একে নেওয়ার তঞ্চংঙ্গ্যা নেতা রনি তঞ্চঙ্গ্যা ও অন্যরা। এর পার পারই আদিবাসীদের ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে নানা আপ্যায়ন ও রকমারি আয়োজন। আজ উদযাপিত হবে মূল বিজু। বৃহস্পতিবার বাংলা সনববর্ষের দিন উদযাপিত হবে গোজ্যাপোজ্যা দিন। মূল বিজুর দিন আদিবাসীদের ঘরে ঘরে আয়োজন করা হয় পারিবারিক উৎসব।
উল্লেখ্য যে, সরকারের পক্ষে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৬ মার্চ দেশের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে সংবিধানে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী” হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে বলে জানিয়েছেন। বিন্তু দেশের ভিন্ন ভাষাভাসী কোনো জাতি ও জনগোষ্ঠীই সে অভিধা মেনে নিচ্ছে না। প্রাত্যেক জাতি ও জনগোষ্ঠীর নিজ পারিচয় নির্ধারণের অধিকার থাকলেও সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা চাপিয়ে দিচ্ছে।